দৈনিক রূপরেখা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫
৩ হাজার কোটি টাকার পাথর লুট: জাফলং-বিছনাকান্দিতে বেপরোয়া চক্রের দাপট
সিলেট প্রতিনিধি:
সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারিতে বেপরোয়া লুটপাটের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। প্রকৃতির অপার সম্ভাবনাময়ী অঞ্চল জাফলং, বিছনাকান্দি, সাদাপাথর ও শাহ আরেফিন টিলাসহ বেশ কয়েকটি পর্যটন এলাকা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
সরকার পতনের ঘোষণার পরপরই, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় বেপরোয়া পাথর লুটপাট। প্রশাসনিক শিথিলতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ লুটপাটকে 'ঐতিহাসিক বিপর্যয়' বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নেতৃত্বের অভিযোগ
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ লুটপাটের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে শতাধিক অবৈধ ক্রাশার মিল চালু রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে চার উপজেলায় প্রায় ৩০০টি অবৈধ ক্রাশারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও কার্যত তা কোনো প্রভাব ফেলেনি।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করা হলেও স্থানীয় পাথরখেকোদের কাছে আগে থেকেই এসব অভিযানের তথ্য চলে যাওয়ায় কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
উপদেষ্টা আটকে দেওয়ার ঘটনা
গত ১৪ জুন জাফলং পরিদর্শনে গেলে দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে দেন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও শ্রমিক দলের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ হয়। তাঁরা জাফলংসহ বন্ধ থাকা কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানান।
হাজার কোটি টাকার লুটপাট
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জাফলংয়ে আগে যেখানে প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত ছিল, এখন সেটি কমে প্রায় ১ কোটি ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। বিগত ১০ মাসে জাফলং ও বিছনাকান্দি অঞ্চল থেকে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
শুধু বিছনাকান্দি এলাকা থেকেই ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরি হয়েছে বলে গোয়াইনঘাট থানায় দায়েরকৃত এক মামলায় উল্লেখ আছে। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় বিএনপির বহিষ্কৃত ও বর্তমান নেতাকর্মীরা।
মামলা হলেও গ্রেপ্তার নেই
জাফলংয়ে পাথর লুটের ঘটনায় ৯টি মামলা হলেও, বেশিরভাগ আসামিই এখনো অধরা। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন যুবদল নেতা আবুল কাশেম, যিনি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
এছাড়া পাথর লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১০টি মামলায় ২৬৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত, প্রকৃতি ধ্বংসের পথে
জাফলং ও বিছনাকান্দির মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্পট এখন পর্যটকশূন্য। পাহাড়, নদী, সবুজ বনানী আর পাথরের মনোরম দৃশ্যপট আজ ভাঙা রাস্তা, কাটা পাহাড়, দখলদারিত্ব আর মেশিনচালিত লুটপাটের দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।
পরিশেষে-- পারখেকোদের এই দৌরাত্ম্য যদি দ্রুত বন্ধ না করা যায়, তবে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন খাত চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রয়োজন কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অন্যথায় শুধু জাফলং নয়, ধ্বংস হবে গোটা সিলেটের পরিবেশ ও অর্থনীতি।
