আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশঃ ২৪ জুন ২০২৫
গত কয়েক সপ্তাহের তীব্র উত্তেজনার পর ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত আপাতত থেমে গেছে। ইরানের নজিরবিহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইলের সীমিত আকারের পাল্টা আঘাতে মধ্যপ্রাচ্যে একটি полномасштабная যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, যেমন রয়টার্স (Reuters), বিবিসি (BBC), এবং আল জাজিরা (Al Jazeera)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, উভয় পক্ষই আপাতত সংঘাত থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এটিকে আনুষ্ঠানিক "যুদ্ধবিরতি" বলা যাচ্ছে না; বরং এটি একটি কৌশলগত ডি-এসকেলেশন বা উত্তেজনা হ্রাস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংঘাতের বর্তমান পরিস্থিতি: যুদ্ধ নয়, আপাতত স্বস্তি
এপ্রিলের শুরুতে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলার পর ইরান সরাসরি ইসরাইলের ভূখণ্ডে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এর জবাবে ইসরাইল ইরানের ইসফাহান শহরের কাছে একটি বিমান ঘাঁটিতে সীমিত পরিসরে হামলা করে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, উভয় পক্ষই নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শন করলেও একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছে। ইরানের কর্মকর্তারা ইসরাইলের হামলাকে তেমন গুরুত্ব দেননি এবং পাল্টা কোনো পদক্ষেপের ঘোষণাও দেননি। অন্যদিকে, ইসরাইলও হামলার দায় সরাসরি স্বীকার না করে একটি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে সরাসরি সংঘাতের অবসান ঘটেছে এবং সাময়িক স্বস্তি ফিরে এসেছে।
যুদ্ধবিরতি নয় কেন? আসল বাস্তবতা কী?
"যুদ্ধবিরতি" বা Ceasefire হলো একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি যা বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ইরান ও ইসরাইলের ক্ষেত্রে এমন কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি বা আলোচনা হয়নি। যা ঘটেছে তা হলো:
আন্তর্জাতিক চাপ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জি-৭ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের জন্য شدید চাপ প্রয়োগ করেছে। পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হলে তা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করে দেবে—এই বার্তা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।
কৌশলগত হিসাব-নিকাশ: ইরান ও ইসরাইল উভয়ই বুঝতে পেরেছে যে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ তাদের জন্য লাভজনক হবে না। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়, আর ইসরাইল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে মনোযোগ ধরে রাখতে চায়।
ছায়া যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরাসরি সংঘাতের পর্ব শেষ হলেও ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিনের "ছায়া যুদ্ধ" (Shadow War) আবার শুরু হবে। অর্থাৎ, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা না করে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি এবং সিরিয়ার মতো प्रॉक्सी শক্তি ব্যবহার করে একে অপরের স্বার্থে আঘাত হানতে থাকবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এই উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস (The New York Times)-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ইরানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পাল্টা হামলা না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে, আরব দেশগুলো, যেমন সৌদি আরব ও জর্ডান, উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, কারণ এই সংঘাত তাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য বড় হুমকি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান ও ইসরাইল উভয়ই তাদের "রেড লাইন" অতিক্রম করেছে, কিন্তু কেউই যুদ্ধ চায়নি। ইরান দেখাতে চেয়েছে যে তারা সরাসরি ইসরাইলে হামলা করার ক্ষমতা রাখে, আর ইসরাইল প্রমাণ করেছে যে তারা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে হামলা চালাতে সক্ষম।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। যদিও সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা কমেছে, তবে যেকোনো ছোট ঘটনা বা ভুল বোঝাবুঝি থেকে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। আপাতত দুই দেশের মনোযোগ আবার তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকেই থাকবে।
পরিশেষে, বর্তমান ইরান-ইসরাইল পরিস্থিতিকে "যুদ্ধবিরতি" বলাটা সঠিক নয়। এটি মূলত আন্তর্জাতিক চাপ এবং নিজস্ব কৌশলগত কারণে সংঘাত থেকে একটি সাময়িক বিরতি। পর্দার আড়ালে তাদের ছায়া যুদ্ধ চলবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও বহাল থাকবে। পরবর্তী যেকোনো পদক্ষেপের জন্য বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
