সেবার নামে হয়রানি: বিআরটিএ ও পুলিশ দুর্নীতির শীর্ষে

দৈনিক রূপরেখা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫


সেবার নামে হয়রানি: বিআরটিএ ও পুলিশ দুর্নীতির শীর্ষে: বিবিএস জরিপ




সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে প্রতি তিনজনের একজন নাগরিক ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন— বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই চিত্র।

জরিপ অনুযায়ী, ৩১.৬৭ শতাংশ নাগরিক সরকারি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩৮.৬২ শতাংশ, যেখানে নারীদের ক্ষেত্রে তা ২২.৭১ শতাংশ। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ (৬৩.২৯%), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (৬১.৯৪%), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%) এবং ভূমি অফিস (৫৪.৯২%)।

বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেলে বিবিএস-এর পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর ১৬ নম্বর লক্ষ্যের ছয়টি সূচক মূল্যায়নে এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার ১,৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (PSU) থেকে ৪৫,৮৮৮টি খানায় সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব ৮৪,৮০৭ জন নারী ও পুরুষ।

নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

জরিপে দেখা যায়, ৮৪.৮১% নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরায় নিরাপদ বোধ করেন। তবে লিঙ্গভেদে এই নিরাপত্তাবোধে পার্থক্য রয়েছে— পুরুষদের মধ্যে ৮৯.৫৩% এবং নারীদের মধ্যে ৮০.৬৭% এই অনুভব করেন। শহরের তুলনায় গ্রামে নাগরিকরা কিছুটা বেশি নিরাপদ বোধ করেন (৮৩.৭৫% বনাম ৮৫.৩০%)। নিজ বাড়িতে নিরাপত্তাবোধের হার ৯২.৫৪%।

তবে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মাত্র ২৭.২৪% নাগরিক ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩১.৮৬%, যেখানে নারীদের মধ্যে তা মাত্র ২৩.০২%। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলার সক্ষমতা অনুভব করেন মাত্র ২১.৯৯% নাগরিক।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি

গত এক বছরে ৪৭.১২% নাগরিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন, যাদের মধ্যে ৮২.৭২% সেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯.৩৪% ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তবে সেবার মান (৬৫.০৭%), স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় প্রদান (৬৩.১৩%) ও আচরণে (৬৩.১৯%) সন্তুষ্টির হার তুলনামূলক কম।

সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক স্তরে প্রবেশাধিকার (৯৬.৪৬%) ও ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে (৯২.৬৬%) বলে উল্লেখ করেন অধিকাংশ নাগরিক। মাধ্যমিক পর্যায়েও এই হার যথাক্রমে ৮২.২০% ও ৮০.৮৬%। মানসম্পন্ন শিক্ষা বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যথাক্রমে ৬৭.৯৩% ও ৭১.৮৬%।

অন্যান্য সরকারি সেবায় প্রাপ্তিযোগ্যতা ভালো, মানের ঘাটতি

পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও নাগরিক নিবন্ধনের মতো সেবায় ৭৮.১২% নাগরিক প্রাপ্তিযোগ্যতায় এবং ৮৬.২৮% ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে বলে মনে করেন। তবে কার্যকরতা, সময়মতো সেবা ও সম-আচরণ নিয়ে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬২.৬০%, ৫১.২৮% ও ৫৬.২৬%।

বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকারে ইতিবাচক প্রবণতা

গত দুই বছরে ১৬.১৬% নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধের সম্মুখীন হন। এদের মধ্যে ৮৩.৬০% বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে ৪১.৩৪% আনুষ্ঠানিক এবং ৬৮.৯৬% অনানুষ্ঠানিক পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন।

বৈষম্য ও হয়রানি এখনও উদ্বেগজনক

গত এক বছরে ১৯.৩১% নাগরিক বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। শহরাঞ্চলে এই হার ২২.০১%, যা গ্রামাঞ্চলের (১৮.০৭%) তুলনায় বেশি। বৈষম্যের কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক (৬.৮২%) ও লিঙ্গভিত্তিক (৪.৪৭%) দিক প্রধান। পরিবার (৪৮.৪৪%), গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থান (৩১.৩০%) এবং কর্মস্থল (২৫.৯৭%) বৈষম্যের প্রধান স্থান। তবে মাত্র ৫.৩৫% ভুক্তভোগী আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন।

বিবিএস জানিয়েছে, এই জরিপের ফলাফল এসডিজি ১৬-এর সূচক মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণে সহায়ক হবে। জরিপটি জাতিসংঘের গ্লোবাল কাস্টোডিয়ান সংস্থা UNDP, UNODC এবং OHCHR-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছে। নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষা ও মতামতের মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে।



Previous Post Next Post