স্টাফ রিপোর্টার | ঢাকা, ২৭ মে ২০২৫
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ১০টায় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
এ রায়কে যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ায় এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ এটি প্রথমবারের মতো এমন একটি মামলা যেখানে রিভিউ আবেদন গৃহীত হওয়ার পর পুনরায় আপিল শুনানি হয় এবং সেই শুনানিতে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
রায়ের প্রেক্ষাপট ও আদালতের পর্যবেক্ষণ
রায়ে বলা হয়, মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। আদালত উল্লেখ করেন, "ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রত্যেক আসামিকে নিরপেক্ষ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচার পাওয়ার অধিকার দিতে হবে।" বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, "কোনো ব্যক্তি অপরাধ না করলে বা অপরাধ প্রমাণ না হলে তাকে সাজা দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।"
আসামিপক্ষের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর জামায়াতের পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন,
“আজহারুল ইসলাম এখন থেকে সম্পূর্ণভাবে আইনিভাবে মুক্ত এবং নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। আমরা এই রায়কে সত্যের বিজয় হিসেবে দেখছি।”
তিনি আরও জানান, তারা আদালতের কাছে রায়ের শর্ট অর্ডার চেয়েছেন এবং আশা করছেন আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আজহারুল ইসলামের মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে।
জামায়াত নেতাদের বক্তব্য
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ড. দেলোয়ার হোসেন তাহের বলেন,
“আল্লাহর বিধান অনুযায়ী, মিথ্যা কখনো টিকে থাকতে পারে না। আজকের রায়ের মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হলো।”
তিনি অভিযোগ করেন, বিগত এক দশকে জামায়াত ও বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলকভাবে যুদ্ধাপরাধের মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জামায়াত-বিএনপির ৬ জন নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং অন্তত ৫ জন জেলেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
মামলার পটভূমি
এটিএম আজহারুল ইসলাম ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট ঢাকার মগবাজারের নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ১৯৭১ সালে রংপুর অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে তিনি আপিল করেন। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ সেই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে এবং ২০২০ সালের ১৫ মার্চ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়।
পরে একই বছরের ১৯ জুলাই তিনি রিভিউ আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত রিভিউ গ্রহণ করে এবং পুনরায় আপিল শুনানির নির্দেশ দেয়। আজকের রায় সেই শুনানির ফলাফল।
জাতীয় পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া
রায় ঘোষণার পর সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদিকে জামায়াত ও তাদের সমর্থকরা এই রায়কে 'সত্যের জয়' হিসেবে দেখলেও, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনগুলো এবং অনেক বিশিষ্টজন এ রায় নিয়ে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
"রায় আইনগত, তবে আমরা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার বজায় রয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করবো।"
এই রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার কার্যক্রমে একটি বড় মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাস দেশের রাজনীতি ও সমাজে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
